‘র’ যেভাবে শেখ হাসিনার ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে’ এগিয়ে এলো | The Mirror Asia

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বিদেশী মিশনগুলোর মধ্যে এখন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশ মিশন। ভারতের ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের উপর নিয়ন্ত্রন রাখা খুবই জরুরি। তাই বাংলাদেশের উপর নিয়ন্ত্রন হারানো ভারতের জন্য উদ্বেগ ও শংকার বিষয়। গত প্রায় দেড় দশকে ‘র’ এর বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বিডিআর বিদ্রোহ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে যেভাবেই হোক আওয়ামী লীগ নিয়ে জিতিয়ে নিয়ে আসা। এই চ্যালেঞ্জ ‘র’ ভালোভাবেই উতরে গেছে। ২০২৪ সালেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে তারা সফল হয়েছে।

দিল্লীর কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ২০২৩ সালের মে মাসে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরে ‘র’ এর তৎকালীন চিফ ও বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করা দু’জন সাবেক হাই কমিশনারের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দীর্ঘ বৈঠক করেন। মূলত ওই বৈঠকেই যুক্তরাষ্ট্রকে বশে করার পরিকল্পনা ঠিক করা হয়। এই পরিকল্পনাতেও ‘র’ সফল হয়েছে। তাই ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা ও ‘র’ উভয়েই নির্ভার ছিল।

সম্প্রতি শেখ হাসিনা দিল্লী সফরে গিয়ে ‘র’ এর সাহায্যের  প্রতিদান স্বরুপ ভারতের সঙ্গে তিনটি চুক্তি করেছেন। বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে এসব চুক্তিতে ভারতকে সুবিধা দেয়া হয়েছে একতরফা ভাবে। মংলা বন্দরের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা ভারতকে দেয়া হয়েছে। বাকী দুটো হচ্ছে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে আসাম ও ত্রিপুরায় রেল চলাচলের করিডোর  ও তিস্তা নদী প্রকল্প। মংলা ও রেল করিডোর চুক্তি শেষ পর্যন্ত হলেও তিস্তা প্রকল্প থেমে যায় বাংলাদেশের কিছু আামলার উদ্দেশ্য প্রনোদিত কালক্ষেপনের কারণে। চুক্তির খসড়া প্রস্তুত হয়নি বলে কৌশলে চুক্তির বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।



বাংলাদেশের আমলাদের একটি সূত্র বলছে, রেল করিডোর চুক্তি সংক্রান্ত ফাইলটি দিল্লির বাংলাদেশী হাইকমিশন বা রেল মন্ত্রনালয়ে নেই। এই ফাইলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আছে। কারণ চুক্তির একটি ধারায় বলা হয়েছে, ‘চলন্ত রেলে ভারত কি পরিবহন করবে তা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ দেখতে ও জানতে পারবে না। তবে ভারতীয় রেল বাংলাদেশ ভূখন্ডে কোন নিরাপত্তাজনিত সংকটে পড়লে বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনীকে সহযোগিতা করবে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী।’ মানে বাংলাদেশে ভারতের সৈন্য প্রবেশ করতে পারবে তাদের রেলকে নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলে। অনেকেই মনে করছেন এই চুক্তি করে ভারত মূলত বাংলাদেশে সৈন্য পাঠানোর এক ধরনের বন্দোবস্তু করে রাখলো।

এই তিনটি চুক্তির বিষয় ফাঁস হওয়ার পর চীন শেখ হাসিনার উপর নাখোশ হয়। চীনের ধারণা বাংলাদেশের রেল কড়িডোর দিয়েই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীনকে ঠেকাতে সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন করা হবে। এ কারণেই শেখ হাসিনা চীন সফর গিয়ে প্রত্যাশিত সফলতা পাননি। চীনের পক্ষ থেকে এরকম শীতল আচরণই করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার চীন সফর নিয়ে যখন দিল্লিতে ‘র’ কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে তখনই ঢাকায় ছাত্ররা কোটা আন্দোলন নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। এই আন্দোলনের গতিবিধির উপর নজর রাখার বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এক নবীন বাঙালি ‘র’ কর্মকর্তাকে।

ওই বাঙালি কর্মকর্তার ১৭ জুলাই পাঠানো তথ্য পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন ‘র’ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। দিল্লীতে ‘র’এর কাছে তথ্য আসে ঢাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর গুলির নির্দেশ দিয়েছে পুলিশের হাইকমান্ড। শুরুতে এটা পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদের অনুসারীদের কাজ হিসাবে ভাবলেও পরে তারা জানতে পারে সরকারের উচ্চমহল বেশ ঘৃণাসূচক শব্দ উচ্চারণ করেই গুলির নির্দেশ দিয়েছে। পুলিশ গুলি করে দমানোর চেষ্টা করলেও ২৪ ঘন্টার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১৮ জুলাই উভয় দেশের সরকার বিচলিত হয়ে পড়ে। দিল্লিতে শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বেশ কয়েকজন ভারতীয় কূটনীতিকের সাথে আলোচনা করে জানায় পরিস্থিতি ‘বিডিআর বিদ্রোহের চেয়ে ভয়াবহ’। তিনি বলেন Our student has rebelled।

এরপর শেখ হাসিনার সঙ্গে ‘র’ প্রধানের সরাসরি ফোনালাপ হয়। ওই আলাপে কারফিউ জারির বিষয়টি উঠে আসে এবং শুক্রবার জুমার নামাজের পর আন্দোলনে জামাত শিবির প্রবেশ বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে বার্তা দেওয়া হয়।

টেলফোন আলোচনায় ‘র’ এর পক্ষ থেকে  কারফিউ জারির পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি দ্রুত একটি দল পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা কারফিউ জারি করতে রাজি হলেও ডিজিএফআইয়ের কাছ থেকে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জানতে চান। কিন্তু ডিজিএফআইয়ের আগেই ‘র’ হাসিনাকে সেনাবাহিনীর বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। উল্লেখ্য ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের পর ডিজিএফআইয়েরই একটি অংশ ‘র’ এর বাংলাদেশ সেলে পরিনত হয়েছে। এরাই মূলত ভারতকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সব তথ্য সরবরাহ করে থাকে। এই সেল ভারতের কাছ থেকে সামরিক অস্ত্র কেনাসহ নানা বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রভাবিত করে।

‘র’ ও শেখ হাসিনার ধারণা ছিল কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু শনিবার ঢাকায় কারফিউ ভেঙে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং অর্ধশত নিহত হয় বলে তথ্য যায় দিল্লিতে। একই সঙ্গে ‘র’ জানতে পারে আওয়ামী লীগের একাংশের নীরব সমর্থন রয়েছে আন্দোলনের প্রতি।

এ অবস্থায় শনিবার দিল্লি ও কলকাতায় একাধিক বৈঠক করে ভারতীয় নীতি নির্ধাকরা। পরামর্শ নেওয়া হয় বাংলাদেশের উপর নজর রাখা সাংবাদিক ও মালদ্বীপে বৈঠকে থাকা ওই দুই ভারতীয় সাবেক কূটনৈতিকেরও। বৈঠকে অনেকেই শেখ হাসিনার দিন শেষ মন্তব্যও করেন। কিন্তু তার মধ্যেই ‘র’ প্রধান বৈঠকে বার্তা একটি বার্তা পাঠায় ‘ কাশ্মীরের অভিজ্ঞতা পূর্বে কাজে লাগাও । প্রয়োজনে পূর্বে আরেকটা কাশ্মীর বানাও তবুও শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখো।’

নির্দেশ পেয়েই ‘র’ এর দলটি শনিবার ঢাকায় তেঁজগাও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ঢাকায় নেমেই ‘র’এর দলটি বৈঠক করে ডিজিএফআই, ডিবি পুলিশ ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বিশেষ নজর রাখা হয় মার্কিন দূতাবাস ও চীনা দূতাবাসের উপর।

শনিবারই সিদ্ধান্ত হয় ২০১৯ সালে কাশ্মীরে দমনের পদ্ধতি অনুসরণ করে ঢাকা মিশন ২০২৪ সফল করা হবে। সব ধরনের ফোন কলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের উপর বিশেষ নজর রাখা হয়। লাশ গুম করার টিমও তৈরী করা হয়। কাশ্মীরের মতই বাড়ি বাড়ি তল্লাশী শুরু করে যৌথ বাহিনী।

‘র’ কর্মকর্তারা সরাসরি ঢাকার মাঠে অবস্থান করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। এ সময় ঢাকায় ভারত বিরোধী নানা গুঞ্জন তৈরী হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলতে শোনা যায় কিছু লোককে। হাইকোর্টের রায় ও সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পাশাপাশি পরিস্থিতি শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ফলে ২৪ জুলাই ‘র’ এর দলটিকে আর মাঠে না নামার  নির্দেশ দেয়া হয় দিল্লি থেকে। ২৫ জুলাই থেকে মাঠ থেকে সরে আসে ‘র’ দলটি। এরপর সহায়ক একটি টিম দিল্লি থেকে পরামর্শ দিচ্ছে।

এর পাশাপাশি দিল্লী ও কলকাতাতেও যেন বাংলাদেশ বিরোধী কোনো বিক্ষোভ না হয় সে বিষয়ে বিশেষ সতর্ককতা অবলম্বন করা হয়। বাংলাদেশ হাই কমিশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়টি তদারক করছে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া এক কর্মকতা। এরপর কলকাতায় বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলো বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশন ঘেরাও করলে দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশন চাপে পড়ে যায়।

২১ জুলাই রবিবার জওহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের এক অধ্যাপককে দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনে মধ্যাহ্ন ভোজনের নিমন্ত্রন করা হয়। ওই মধ্যাহ্ন ভোজনে জওহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থি সংগঠনগুলো যেন দিল্লিতে কোন বিক্ষোভ না করে বা হাইকমিশন ঘেরাও করতে না আসে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় এই অধ্যাপককে।

Copy post | Read on The Mirror Asia: